ভালবাসার গল্প: রূপকথার শহর! (নবনী নীলা)পর্ব-৫
ইশাকে আমিনুল সাহেব তার বাড়ির গেটের সামনে নামিয়ে দিলেন। কায়ান নামের এই লোকটার প্রতি ইশার এক আগ্রহ কাজ করছে। লোকটা যদি এত ভয়ানক হয় তাহলে এর আগে সে এই নামটি শুনেনি কেনো?
ইশা নিজের বাড়িতে ঢুকতেই তার বড় ভাই ডেকে পাঠালেন।ইশার বড় ভাই আবির। ইশার থেকে আট বছরের বড়। ইশা ভাইয়ের রুমে যেতেই দেখলো তার ভাই টিভিতে খবর দেখছে।
ভাইয়া ডেকেছো আমায়?”
হ্যাঁ, ভিতরে এসে বস। আজকে তোর ভার্সিটিতে কি হয়েছে ? খবরে কিসব দেখাচ্ছে।
ইশা কি বলবে আর কি বলবে না বুঝতে পারছে না। ইতস্তত করে বলল,“ খবরে যা বলছে আমরা সেটাই জানি। মামা তো পুলিশের কাছে গেলো। তারা নাকি কিছু বলতে চায় নি।”
এইসব ঝামেলার মধ্যে তোর ভার্সিটিতে যাওয়ার দরকার নেই।
কিছু থেকে কিছু হলেই এই বাড়ি থেকে তার ভার্সিটি যাওয়াটা বন্ধ করে দেয় । কিন্তু কেনো? সবাই যেতে পারলে সে যেতে পারবে না কেনো?
ইশা মলিন গলায় বলল, “ না ভাইয়া যেতে হবে। একটা বদমাইস স্যার এসেছে। তার ক্লাসে অ্যাটেন্টড না করলে সে একদম অগ্নিমূর্ত হয়ে যায়।”
সে স্যার যতই বদমাইস আর হিটলার হোক না কেনো তুই যাবি না। এখন রুমে গিয়ে রেস্ট কর।”
তাহলে বাইরে অন্তত ঘুরতে যেতে তো পারবো। ভার্সিটি না হয় নাই গেলাম।”
আবির হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই ইশা নাচতে নাচতে নিজের রুমে চলে গেলো।
পরেরদিন, বিকেলে ইশা ঘুরতে বেরিয়েছে রিতুকে সাথে নিয়ে। ঘুরাঘুরি খাওয়া দাওয়া করতে করতে সন্ধ্যার পর হয়ে গেলো। ইশা রিতুকে রিতুর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে রিকশা করে ফিরছিলো। হঠাৎ রিকশার চাকায় সমস্যা হতেই মাঝ রাস্তায় ইশাকে নেমে যেতে হলো।
যেই জায়গায় ইশা দাঁড়িয়ে আছে। এইখানে গাড়ি কিংবা রিকশা পাওয়া মুশকিল, খুবই নির্জন জায়গা। ল্যাম্পপোষ্টের আলো টিম টিম করে জ্বলছে, চারিদিকে নীরবতা ছড়িয়ে আছে। আশেপাশে তাকাতেই ইশার অসস্তি হতে লাগলো। ইশা হাঁটতে শুরু করলো। তার উদ্দেশ্য এই গলি থেকে বের হয়ে মেইন রোডে পৌঁছানো।
ইশা হাঁটতে হাঁটতেই পর পর দুইটি গুলির শব্দ শুনতে পেলো। ইশা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো, তার হৃদস্পন্দন যেনো বেড়ে গেলো। ইশা একটু আড়ালে সরে গেলো। তারপর আড়ালে দেখার চেষ্টা করতেই একটা ছায়া দেখতে পেলো পিস্তল হাতে। ইশা দুই হাতে মুখ চেপে দেওয়ালের সাথে ঘেঁষে দাড়িয়ে পড়লো। ভয় ইশার প্রাণ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। ইশা পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে, কে যেনো ঐদিকেই আসছে। পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে আরো স্পষ্ট হতেই ইশা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। পায়ের শব্দটা তার খুব কাছে এসে মিলিয়ে যেতেই ইশা আস্তে আস্তে চোখ খুললো।
তারপর যা দেখলো, ইশা তা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। আরহান তার দিকে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।
আরহান এইখানে ইশাকে দেখবে ভাবতে পারেনি। এতো রাতে এমন নির্জন জায়গায় কি করছে সে? আরহান সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল নামিয়ে ফেললো। ইশা অপলকে তাকিয়ে আছে। তাহলে একটু আগে যে গুলির শব্দ শুনতে পেলো! কিভাবে সম্ভব?
আরহান ইশার চোখে মুখে প্রচণ্ড ভয় দেখে বলল, “ রিল্যাক্স! ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
ইশা ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে লাগলো। বার বার তার চোখ যাচ্ছে আরহানের হাতের পিস্তলের দিকে।
আরহান ইশার কাছে এগিয়ে এসো বললো, “ তুমি এই জায়গায় একা একা কি করছো?”
ইশা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, “ আমি বাড়ি ফিরছিলাম, রাস্তায় রিকশার চাকা নষ্ট হয়ে যায়।”
আচ্ছা। আসো আমি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।”
ইশা সাথে সাথে না সূচক মাথা নেড়ে বলল। “ আমি চলে যেতে পারবো।”
কেনো? আমার সাথে আসতে কি অসুবিধা?” আরহানের প্রশ্নে ইশা আরহানের হাতে থাকা পিস্তলের দিকে তাকালো।
আরহান জানে ইশার মনে কিসের ভয় আর তার চোখে কেনো এতো প্রশ্ন।
তুমি কি এই পিস্তলের কারণে আমার সাথে যেতে চাইছো না। ভয় পাচ্ছো?” বলেই আরহান আরেক ধাপ এগিয়ে আসলো। ইশা প্রথম থেকেই দেওয়ালের সাথে আঁশটে পিষ্টে দাঁড়িয়ে ছিলো। তাই পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
যদি ভয় পেয়ে থাকো, তাহলে তোমার মনে হয় না আমাকে না করাটা খুব বোকামি হয়ে যাবে?” বলেই আরহান ইশার চোখে চোখ রাখলো।
তাই চুপ চাপ আমার সাথে আসো।” শেষটা বলেই আরহান ইশার হাত ধরলো। ইশা খেয়াল করলো আরহান তার হাতে খুব একটা চাপ না দিয়েই ধরে আছে। যা গতকালের চেয়ে আলাদা, একদম ভিন্ন। আরহান ইশার হাত ধরে সেই গলি থেকে বের করে নিয়ে আসলো। আরহানের পিস্তলটার মাথা প্যান্টের পকেটে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।
ইশা মেইন রোডে আসতেই দেখলো আরহানের গাড়ি রাস্তার একপাশে পার্ক করা। ইশার মনে হাজারটা প্রশ্ন, কিন্তু সে চুপ থাকলো। আরহান ইশাকে গাড়িতে বসিয়ে কাকে যেন কল দিলো।
ইশা গাড়ির সিটে মাথা হেলিয়ে দিলো। যা হয়েছে, যা সে দেখেছে সবটা বার বার তার মনে পড়ছে। ইশা বড় বড় নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।
ইশার মনে অনেক প্রশ্ন। আরহান এইখানে কি করছে? তার গাড়ি যেহেতু মেইন রোডে পার্ক করা তাহলে নিশ্চয়ই সে কোনো কাজে এইখানে এসেছে? আর সেই গুলির শব্দ যেটা ইশার কানে ভেসে আসলো সেটা কি আরহান!!
ইশার অস্থিরতা বাড়তেই ইশা গাড়ির ড্রায়ার খুললো পানির বোতলের জন্য। সেখানে পানির বোতল ছিলনা ঠিকই কিন্তু ইশার চোখে পড়লো অন্য কিছুতে , কাগজে মোড়ানো একটা প্যাকেট। ইশা সাথে সাথে ড্রায়ারটা বন্ধ করে ফেললো এবং বাইরে তাকাতেই দেখলো আরহান এখনো ফোন কার সাথে যেনো কথা বলে যাচ্ছে।
ইশা যে তার ড্রায়ার খুলেছে সেটা সে দেখেনি। সে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু এই প্যাকেটে কি আছে সেটা না দেখা পর্যন্ত ইশার মন শান্ত হবে না।
আরহান গাড়িতে দরজা খুলতেই ইশা বলল, “ আপনার কাছে পানি হবে?
ইশা জানে এই গাড়িতে পানি নেই। সে সব জায়গায় খুঁজেছে।
নাহ । ওয়েট আমি আনছি।”, আরহান গাড়ির দরজা বন্ধ করে সামনের দোকানে গেলো পানির বোতল কিনতে।
এই সুযোগে ইশা আবারো গাড়ির ড্রায়ারটা খুললো। তারপর খুব সাবধানে প্যাকেটটা হাতে নিলো। ইশার ভীষণ ভয় লাগছে। কি না কি আছে ভিতরে! কিন্তু না দেখেও তো সে থাকতে পারছে না। ইশা আস্তে করে প্যাকেটটা খুলতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। এইদিকে আরহান কে আসতে দেখেই ইশা তাড়াতাড়ি প্যাকেটটা ড্রয়ারে রেখে দিলো।
আরহান গাড়ির দরজা খুলে ইশাকে পানির বোতল দিতেই ইশা চোখের পলক ফেলে তাকালো। তারপর নিঃশব্দে পানির বোতলটা হাত বাড়িয়ে নিলো।
আরহান ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলল, “ তুমি এখনো ভয় পাচ্ছো আমাকে?”
ইশা উত্তরে কিছু না বলে এক ঢোক পানি খেয়ে বোতলটা এক পাশে রাখলো।
তারপর বলল, “ আসলে আমি সেখানে দুটো গুলির শব্দ পাই। আর আপনার সাথে পিস্তল দেখে ভেবেছিলাম…..।” বলতে বলতে ইশা থেমে যায়।
কি ভেবেছিলে যে আমি গুলি করেছি ?” আরহানের প্রশ্নের উত্তরে নিচের ঠোঁট কামড়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
আরহান না হেসে পারলো না, এই টেনশনের মধ্যেও তার ঠোঁট দুঠো প্রসারিত হয়ে গেলো ইশার কথায়। ইশা অবাক হয়ে আরহানের হাসির দিকে তাকালো। লোকটা বুঝি হাসতেও জানে? তাও এতো সুন্দর করে।
আরহানের রাস্তার দিকে দৃষ্টি রেখে বলল, “ আমিও গুলির শব্দ পেয়েই সেখান গিয়েছি।”
সত্যিই?”ইশার প্রশ্নে আরহান আড় চোখে তাকালো।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইশা বলল, “ আপনাকে একটা প্রশ্ন করি ?
হুম, করো।”
আপনি কি সব সময় সাথে পিস্তল রাখেন?, ইশা আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করতেই আরহান বলল, “ এটা আমার শখ।”
পি*স্ত*ল রাখা আপনার শখ।” ইশা হতভম্ব হয়ে তাকালো। নাহ ঠিকই আছে। আর পাঁচটা মানুষের মতন নরমাল শখ থাকার তো কথা না আরহান আহমেদের। তার থাকবে পিস্তলের শখ।
আপনি কি জানেন আপনি কতটা ব্যতিক্রম আর পাঁচটা মানুষ থেকে?”
কিভাবে ব্যতিক্রম আমি ?”
মেজাজ থেকে শুরু করে সব দিক থেকেই। এমনকি আপনাকে কোনো ভাবেই ভার্সিটির প্রফেসর মনে হয় না।”
আরহান নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, “ তাহলে কি মনে হয় ?”
মনে হয়, আপনি অন্য কেউ।”
আরহান গাড়ি ব্রেক করতেই, ইশা অবাক হয়ে বলল,” গাড়ি থামালেন কেনো?”
কারণ তোমার বাড়ির সামনে।”,আরহানের কথায় ইশার হুশ ফিরল।
ইশা থ্যাংক ইউ বলে নেমে কিছু দুর যেতেই আরহান গাড়ি থেকে নেমে ইশাকে ডাকলো। আরহানের শুধু ইশার রোল নাম্বরটাই মনে আছে তাই সে ডাকলো, “ একশ এগারো।”
ইশা কটমট করে পিছনে তাকালো। তারপর আরহান এগিয়ে আসতেই বলল, “ আপনি আমার নাম জানেন না ? একশ এগারো ডাকেন কেনো?”
তোমার ব্যাগ।” আরহান ব্যাগটা এগিয়ে দিতেই ইশার মনে পড়ল সে তার ব্যাগ গাড়িতেই ফেলে এসেছে।
ইশা ব্যাগটা হাতে নিতে নিতে বলল, “ আমার নাম ইশা। কি বলেছি শুনেছেন?”
আরহান পাত্তা না দিয়ে ঠোটের কোনে হাসি রেখে নিজের গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
ইশা কিছুক্ষণ দাড়িয়ে আরহানের চলে যাওয়া দেখলো। ইশার সন্ধেহ যায় নি। পিস্তল হাতে আরহানের ওই জায়গায় একই সময়ে উপস্থিত হওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না। এবং মেইন রাস্তায় গুলির শব্দ পৌঁছানোর সম্ভবনা নেই। আর কোনো সাধারণ মানুষের পিস্তল রাখার শখ কেনো হবে ?
ইশা নিজের রুমে গিয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতে গিয়ে দেখলো কাগজে মোড়ানো এক ডজন কাচের চুড়ি। কি ব্যাপার! তার বাগে কাচের চুড়ি আসলো কিভাবে?ইশা চুড়িগুলো ভালো ভাবে দেখলো। ইশা বুঝতে পারছে না তার কেমন অনুভব করা উচিত? কারণ এই কাচের চুড়ি গুলোই ইশা আরহানের গাড়ির ড্রয়ারে দেখেছিলো।
আরোও পড়ুন:
0 Comments