ই-পাসপোর্ট/ডিজিটাল পাসপোর্ট কি? জেনে নিন ডিজিটাল পাসপোর্ট এর সকল সুবিধাগুলো!

ডিজিটাল পাসপোর্ট, যা ই-পাসপোর্ট (e-Passport) নামেও পরিচিত, হলো একটি আধুনিক ভ্রমণ নথি যেখানে একটি মাইক্রোচিপ বসানো থাকে। এই চিপে পাসপোর্টধারীর ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন - নাম, জন্মতারিখ, ছবি, ডিজিটাল স্বাক্ষর, এবং বায়োমেট্রিক তথ্য (যেমন: আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ স্ক্যান) সুরক্ষিতভাবে সংরক্ষিত থাকে। এটি প্রচলিত কাগজের পাসপোর্টের উন্নত সংস্করণ, যা নিরাপত্তা ও ভ্রমণ প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করে তোলে। ডিজিটাল পাসপোর্টের সুবিধাগুলো: ডিজিটাল পাসপোর্ট চালু হওয়ার ফলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা পাওয়া যায়, যা ভ্রমণকারীদের জন্য নিরাপত্তা এবং গতি উভয়ই বাড়িয়ে তোলে:



উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা:

ই-পাসপোর্টে থাকা মাইক্রোচিপের কারণে এটি নকল করা বা জালিয়াতি করা অত্যন্ত কঠিন। চিপে সংরক্ষিত বায়োমেট্রিক তথ্য (আঙ্গুলের ছাপ, আইরিশ স্ক্যান) পরিচয় চুরির ঝুঁকি কমায় এবং পাসপোর্টধারীর পরিচয় যাচাইয়ে বাড়তি সুরক্ষা প্রদান করে।

দ্রুত ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া:

ই-পাসপোর্টের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ই-গেট ব্যবহার করে দ্রুত ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করা। বিমানবন্দরে ই-গেটের নির্দিষ্ট স্থানে পাসপোর্ট রাখলে ক্যামেরা ছবি তুলে নেবে এবং আঙ্গুলের ছাপ যাচাই করবে। সব তথ্য সঠিক থাকলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ইমিগ্রেশন পেরিয়ে যাওয়া যায়। এর ফলে লম্বা লাইনে দাঁড়ানোর ঝামেলা কমে এবং সময় বাঁচে।

আন্তর্জাতিক মান:

ই-পাসপোর্ট আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (ICAO) এর মান অনুযায়ী তৈরি করা হয়। এর ফলে বিশ্বজুড়ে ই-পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়, যা আন্তর্জাতিক ভ্রমণকে আরও সহজ করে তোলে।

তথ্য সুরক্ষা:

চিপে সংরক্ষিত তথ্য এনক্রিপ্ট করা থাকে, যা অননুমোদিত অ্যাক্সেস থেকে ব্যক্তিগত তথ্যকে সুরক্ষিত রাখে।

কাগজপত্র সত্যায়ন ও ছবি সংযুক্তির ঝামেলা নেই:

ই-পাসপোর্টের আবেদনের ক্ষেত্রে কোনো কাগজপত্র সত্যায়ন করার বা ছবিতে সত্যায়ন করার প্রয়োজন হয় না, যা প্রক্রিয়াটিকে আরও সহজ করে তোলে।

ভুল তথ্যের সম্ভাবনা হ্রাস:

বায়োমেট্রিক তথ্যের কারণে ভুল বা মিথ্যা পরিচয়ে পাসপোর্ট তৈরি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। 

দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা:

ই-পাসপোর্ট সাধারণত ৫ বা ১০ বছরের জন্য ইস্যু করা হয়, যা মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (MRP) তুলনায় এর মেয়াদ একই থাকে। সংক্ষেপে, ডিজিটাল পাসপোর্ট আধুনিক প্রযুক্তির এক চমৎকার সংযোজন যা ভ্রমণকে আরও নিরাপদ, দ্রুত এবং সুবিধাজনক করে তুলেছে।

ডিজিটাল পাসপোর্ট বা ই-পাসপোর্ট বানাতে কি কি প্রয়োজন?

ডিজিটাল পাসপোর্ট বা ই-পাসপোর্ট বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং প্রক্রিয়া কিছুটা আবেদনকারীর বয়স, পেশা এবং পূর্ববর্তী পাসপোর্টের অবস্থার উপর নির্ভর করে। তবে কিছু মৌলিক কাগজপত্র প্রায় সবার জন্যই প্রযোজ্য।

চলুন জেনে নেই বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে:

১. অনলাইন আবেদনপত্রের প্রিন্ট কপি: 

ই-পাসপোর্ট পোর্টালে (www.epassport.gov.bd) অনলাইনে আবেদনপত্র পূরণ করতে হবে এবং পূরণ করা আবেদনপত্রের সারসংক্ষেপ বা সামারি (Summary) ও অ্যাপ্লিকেশন ফরম এর প্রিন্ট কপি সাথে নিতে হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট তারিখ উল্লেখ থাকলে সেটিরও প্রিন্ট কপি নিতে হবে।

২. জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) / অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদ (BRC):

জাতীয় পরিচয়পত্রের মূল কপি এবং ফটোকপি (২০ বছরের ঊর্ধ্বে হলে আবশ্যক)।

১৮ বছরের কম বয়সীদের জন্য অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদ (BRC English Version) এর মূল কপি এবং ফটোকপি (অনলাইনে ভেরিফাইযোগ্য হতে হবে)।

১৮-২০ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে NID বা BRC উভয়ই গ্রহণযোগ্য।

শিশুদের ক্ষেত্রে (৬ বছরের কম) পিতা-মাতার NID কার্ডের কপি আবশ্যক।

৩. পূর্ববর্তী পাসপোর্ট (যদি থাকে):

পূর্ববর্তী মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (MRP) এর মূল কপি এবং ফটোকপি (ডেটা পেজ)।

যদি পূর্ববর্তী পাসপোর্টে কোনো তথ্য পরিবর্তন বা ভুল থাকে, তবে সেগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (যেমন: অঙ্গীকারনামা, শিক্ষাগত সনদ ইত্যাদি) সাথে নিতে হবে।

৪. পাসপোর্ট ফি জমা দেওয়ার রশিদ:

ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধিত ফি এর মূল চালান (Automated Challan বা A-Challan) এর প্রিন্ট কপি। মনে রাখবেন, ই-পাসপোর্টের ফি অনলাইনে বা মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে পরিশোধিত হলেও অফলাইনে ব্যাংক স্লিপের প্রয়োজন হতে পারে। ফি'র সাথে ১৫% ভ্যাট (VAT) সংযোজিত হয়।

৫. বর্তমান ঠিকানা প্রমাণের জন্য:

বর্তমান ঠিকানার সমর্থনে ইউটিলিটি বিলের কপি (যেমন: গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল, পানির বিল) এর মূল ও ফটোকপি।

প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, চাকরির আইডি কার্ড (Job ID) বা স্টুডেন্ট আইডি (Student ID)-ও ব্যবহার করা যেতে পারে।

৬. পেশাভিত্তিক প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে):

সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য: অনাপত্তি পত্র (NOC) বা GO (Government Order) এর মূল ও ফটোকপি। এটি অবশ্যই ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে আপলোড থাকতে হবে। 

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য: অবসরের প্রমাণপত্র হিসেবে পেনশন দলিল বা PRL (Post Retirement Leave) এর আদেশ/পেনশন বই এর কপি। 

টেকনিক্যাল পেশার ক্ষেত্রে (যেমন: ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ড্রাইভার ইত্যাদি): সংশ্লিষ্ট টেকনিক্যাল সনদের কপি।


৭. বৈবাহিক অবস্থা সংক্রান্ত কাগজপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে): 

* বিবাহিতদের জন্য: বিবাহ সনদ/নিকাহনামা এর কপি।

* বিবাহ বিচ্ছেদ হলে: তালাকনামা এর কপি।

৮. অন্যান্য বিশেষ কাগজপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে):

* হারানো পাসপোর্টের ক্ষেত্রে: সাধারণ ডায়েরী (GD) এর মূল কপি।

* দত্তক/অভিভাবকত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে: সুরক্ষা সেবা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারীকৃত আদেশের কপি।

* তথ্য সংশোধনের ক্ষেত্রে (যেমন: নাম, বয়স, পেশা পরিবর্তন): সংশ্লিষ্ট শিক্ষাগত সনদ (JSC/SSC/HSC/সমমান), NID, সার্ভিস রেকর্ড ইত্যাদি কাগজপত্র। এক্ষেত্রে NID এবং পূর্বের পাসপোর্টের তথ্যের গড়মিল থাকলে নির্ধারিত ফরম্যাটে পূরণকৃত অঙ্গীকারনামা দাখিল করতে হবে।

* দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের Dual Citizenship সনদ।

* ৬ (ছয়) বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে: রঙ্গিন পোশাক পরিহিত পাসপোর্ট সাইজের (3R সাইজ, ধূসর ব্যাকগ্রাউন্ড) ল্যাব প্রিন্টেড ছবি।

৯. ছবি:

* ই-পাসপোর্টের আবেদনের সময় কোনো ছবি সংযুক্ত করার বা সত্যায়নের প্রয়োজন হয় না। পাসপোর্ট অফিসে বায়োমেট্রিক এনরোলমেন্টের সময় আপনার ছবি তোলা হবে।

* ছবি তোলার সময় রঙিন পোশাক পরিধান করা আবশ্যক। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ:

* আবেদন অনলাইনেই করতে হবে: epassport.gov.bd ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।

* কোনো কাগজপত্র সত্যায়নের প্রয়োজন নেই: ই-পাসপোর্ট আবেদনের ক্ষেত্রে কোনো কাগজপত্র সত্যায়ন করার প্রয়োজন হয় না।

* উপস্থিতি বাধ্যতামূলক: বায়োমেট্রিক ডেটা (আঙ্গুলের ছাপ, আইরিশ স্ক্যান এবং ছবি) প্রদানের জন্য আবেদনকারীকে অবশ্যই নির্ধারিত পাসপোর্ট অফিসে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে।

* বর্তমান ঠিকানা: আবেদন করার সময় বর্তমান ঠিকানা সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস/আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দাখিল করতে হবে। সবচেয়ে নির্ভুল ও হালনাগাদ তথ্যের জন্য সর্বদা বাংলাদেশ ই-পাসপোর্ট অনলাইন রেজিস্ট্রেশন পোর্টাল (www.epassport.gov.bd) এর নির্দেশনা অনুসরণ করা উচিত।

Post a Comment

0 Comments