ভালবাসার গল্প: রূপকথার শহর! (নবনী নীলা)পর্ব-১১
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিঃশব্দে বসে আছে আরহান। তার মুখে চিন্তার ছায়া, কপালটা ভাঁজ পড়ে আছে। পাশের বেডে শুয়ে আছেন সেই বৃদ্ধা—যিনি রাস্তায় হঠাৎ করে তার গাড়ির সামনে এসে পড়েছিলো।
নার্স এসে বৃদ্ধার হাতে স্যালাইন সেট করে দিয়ে বলল,“মোটামুটি ঠিক আছেন এখন। বয়সের কারণে একটু কনফিউশন হচ্ছে মনে হয়। আত্মীয় বা ঠিকানা কিছু বলছেন না।”
আরহান ধীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “কেউ এসেছে খোঁজ নিতে?” নার্স মাথা নাড়ল, “না স্যার। কোনো রেসপন্স নেই। আমরা পুলিশ ইনফর্ম করেছি।”
বৃদ্ধা হঠাৎ চোখ মেলে তাকালেন। চাহনিতে যেন বিস্ময়, আবার যেন স্বস্তি। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে সে ধীরে ধীরে হাত বাড়ালেন আরহানের দিকে।
“তুই... তুই এসে গেছিস খোকা...!”কণ্ঠটা কেঁপে ওঠে, আবেগে টলমল করে।
আরহান বিস্মিত হয়ে বলল, “আমি আপনার ছেলে না। আপনি ভুল করছেন।”
বৃদ্ধার কাঁপা কাঁপা হাতটা এসে ছুঁয়ে যায় আরহানের গাল। আরহান অবচেতনে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে যায়।
“আমি জানতাম, তুই একদিন ফিরবি... তুই বেঁচে আছিস...”
আরহান গলার স্বর নিচু করে বলে, “ আপনি ভুল করছেন।”
বৃদ্ধার চোখ ভরে ওঠে জল দিয়ে। “ তুই রাগ করিস এখনো? আমার খোকা তো রাগী ছিলো ছোটবেলা থেকেই…”
আরহান অসহায়ভাবে চারপাশে তাকায়, যেন কোথাও একটা উত্তর খুঁজছে। নার্স এসে আবার কিছু বলতেই বৃদ্ধা হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলে উঠে,“এটা আমার ছেলে! আমার খোকা!”
হাসপাতালের অন্য রোগীরাও তাকাতে শুরু করে। পরিস্থিতি অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে। বৃদ্ধা কেঁদে ফেলেন। “ ও হারিয়ে যাবে আবার...” আরহান চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
ঘণ্টা খানেক পরে, পুলিশ এসে বৃদ্ধার বিষয়ে রিপোর্ট করে। পরিচয় প্রমাণ কিছু মেলেনি। ডাক্তার বলল, হয়তো ডিমেনশিয়া বা ট্রমার কারণে বৃদ্ধার স্মৃতি গুলিয়ে গেছে।
“কিছুদিন হাসপাতালে রাখা হবে, এরপর ওল্ড হোম বা গার্ডিয়ান হ্যান্ডওভার—আইন অনুযায়ী প্রক্রিয়া হবে,” জানাল এক অফিসার।
আরহান চুপ করে সব শুনল, তারপর হঠাৎ বলল,
“ওনার পরিবারকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আমি ওনার দায়িত্ব নিচ্ছি।”
সবাই অবাক। পুলিশ বলল, “স্যার, আপনি তো বললেন উনি আপনার মা না।”
“ হ্যাঁ, কিন্তু এইভাবে রেখে গেলে উনি আরো বেশি ছটফট করবেন।” কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরহান চোখ নামিয়ে বলল।
পরে বৃদ্ধার ঔষধ ও নরম একটা শাল কিনে নিয়ে আরহান তাঁকে নিজের গাড়িতে তুলল। গাড়ির দরজার পাশ থেকে বৃদ্ধা আবার বললেন,“খোকা, আমরা কি এখন বাড়ি যাচ্ছি?”
আরহান কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো তার চোখে। তারপর ধীরে মাথা নেড়ে বলল,“হ্যাঁ… আমরা এখন ‘বাড়ি’ যাচ্ছি।”
ঘরের দরজা বন্ধ। আলো ক্ষীণ। আয়নার সামনে বসে আছে কায়ান—নিঃশব্দ, ঠান্ডা, কেন্দ্রীভূত।
কায়ান আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের শরীর দেখলো। তারপর কায়ান মেকআপ বক্স খুলে। ত্বকের রঙ মিলিয়ে নেয়া একপ্রকার বিশেষ কনসিলার দিয়ে সে নিজ হাতের চিহ্নগুলো ঢেকে ফেলতে শুরু করলো। প্রতিটি ট্যাটু যেন কায়ানের জীবনের একেকটা অধ্যায়—হিংস্রতা, বিশ্বাসঘাতকতা, এবং প্রতিশোধ।
তারপর সে এগিয়ে যায় ড্রেসিং টেবিলের দিকে।
হুবহু আরহানের পোশাকের ধরণ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যেমনটা আরহানের স্টাইল।
কায়ান ধীরে ধীরে পোশাকগুলো পরে। তারপর একপাশে রাখা টেবিল থেকে সে দেখে আরহানের চলাফেরা বিশ্লেষণের ভিডিও। মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে—আরহান কীভাবে হাঁটে, কীভাবে থামে, কীভাবে কারো দিকে তাকায়।
কায়ান বারবার আয়নার সামনে সেই ভঙ্গি অনুকরণ করে।
“ধৈর্য। নিখুঁত ছদ্মবেশের জন্য চাই ধৈর্য… আর সময়।” নিজের প্রতিফলনের দিকে তাকিয়ে কায়ান ঠান্ডা হাসি দেয়।
রুবান দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়,“বস, ভিতরে ঢোকার প্ল্যান কি আজ রাতে এক্সেকিউট করা হবে ?”
কায়ান ঘুরে তাকায়, তার চোখে সাপের মতো শীতল আলো।“ হ্যাঁ।”
তারপরে কায়ান নিজের হাতে ছোট ডিভাইস ব্যাগ খুলে। প্রতিটা ডিভাইস সাইলেন্ট ড্রোন, সিগন্যাল ব্লকার, ইনফ্রারেড সেন্সর সে নিজ হাতে চেক করে। একটা ছোট, সুঁচের মতো ডিভাইস তুলে নিয়ে বলে,“ আজ রাতে যেনো কোনো ভুল না হয়।”
রুবান নিচু গলায় বলে,“ জ্বি অবশ্যই?”
“ মায়ের দিকে খেয়াল রাখছো তো?” কায়ানের হঠাৎ নিজের মায়ের প্রসঙ্গ তুলায় রুবান যেনো দম ফেলতে ভুলে গেলো।যেনো নিজের মৃত্যু দেখতে পেলো সামনে।রুবান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই কায়ান বেরিয়ে যায়।
বিকেলের নরম আলো ছড়িয়ে আছে ভিলার চারপাশে। দরজা খুলে ঢুকছে আরহান, সাথে সেই বৃদ্ধাকে হাত ধরে ধরে হাঁটাচ্ছে। বৃদ্ধার চোখে এখনও একধরনের স্বপ্নবিলাসী উজ্জ্বলতা।
ইশা লিভিংরুমে দাঁড়িয়ে ছিল। আরহানের পাশে থাকা অচেনা মুখ দেখে চমকে ওঠে সে।
বৃদ্ধা এগিয়ে এসে ইশার মুখে হাত বুলিয়ে দেয়।
“এই মিষ্টি মেয়েটি কে রে খোকা!”
ইশা পুরো হতবাক। তার চোখ চলে যায় আরহানের দিকে।চোখে একটা স্পষ্ট প্রশ্ন, “কে উনি?”
আরহান একটু ইতস্তত করে বলল,
“আজ রাস্তায়… একটা দুর্ঘটনা হয়েছিল। এরপর থেকে উনি আমাকে নিজের ছেলে ভেবেছেন।”
ইশা ধীরে ধীরে বলল,“ এই কারণে আপনি উনাকে এইখানে এনেছেন?”
আরহান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে,“ হ্যাঁ। আপাদত থানায় ডায়েরি করেছি। কিন্তু উনি হাসপাতালে একা থাকতেও চাইছেন না।”
ইশা চোখ বড় বড় করে আরহানের দিকে তাকালো কিন্তু আরহান কোনো কথা না বলে ক্লান্ত পায়ে নিজের রুমের দিকে চলে যায়।
ইশা অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, আর বৃদ্ধা তার হাত চেপে ধরে বলে,“তোকে দেখেই মনটা জুড়িয়ে গেল মা। আমি অনেকদিন পরে শান্তি পেলাম…”
ইশার মুখের অভিব্যক্তি ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে।সে বুঝে যায়, এই নারীর সঙ্গে কোনও রহস্য জড়িয়ে আছে।
ভিলার বারান্দার পাশে বসে আছে ইশা ও সেই বৃদ্ধা। নরম বাতাস বইছে। চারপাশে একধরনের নীরবতা।
ইশা সাবধানে প্রশ্ন করে,“আপনার নাম কী?”
বৃদ্ধা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,“আমার নাম... ফাহিমা। ফাহিমা খাতুন।”
“আপনার বাড়ি কোথায়?”
বৃদ্ধা ভ্রু কুঁচকে ফেলে। মাথা নিচু করে ফেলে, যেন মনে করার চেষ্টা করছে।
“আমি... আমি জানি না মা। সব মনে পড়ে না। শুধু কিছু জিনিস ভাসে মাথায়... একটা পুকুরঘাট... একটা সুন্দর বাড়ি... আর আমার দুই ছেলে একসাথে খেলছে।”
ইশা অবাক হয়ে বলে,“দুই ছেলে?”
ফাহিমা হালকা হেসে ফেলে, চোখে দূরের তাকানো দৃষ্টি, “হ্যাঁ. দুই ছেলে আমার। বড়টা ছিল শান্ত, রাগী। আর ছোটটা দুষ্টু, জেদি। কিন্তু ছোটবেলায় বড় খোকাকে কোথায় যে হারিয়ে ফেললাম , আর কোনোদিন খুঁজে পাইনি।”
ইশা ধীরে ধীরে বলে, “আর ছোট ছেলেটা?”
“ দুজনে এতো মিল ওদের।”
ইশার মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সে বুঝতে পারে—ফাহিমা ‘অতীত’ খুব স্পষ্টভাবে মনে রাখতে পারছেন, কিন্তু ‘বর্তমান’ নিয়ে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত।
ইশা ধীরে ধীরে বলে,“ আপনি কীভাবে চিনলেন আপনার খোকা উনি?” বলেই ব্যাস্ত আরহানের দিকে ইশারা করলো।
ফাহিমা মাথা নেড়ে বলে,“চোখে পড়তেই মনে হলো… ও-ই আমার খোকা। কতোবার ওকে খুঁজেছি জানো মা! ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা… আমি জানি, এটাই আমার খোকা।”
বৃদ্ধার সাথে কথা বলে ইশার মনটা ভারী হয়ে গেলো।
রাত নামতে শুরু করেছে। ভিলার চারপাশে যেন নিঃশব্দ ছায়ারা হাঁটছে।আরহান ফোনে কথা বলতে বলতে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছেন। তার কণ্ঠে স্পষ্ট তাড়াহুড়োর ছাপ।
“ইশা, আমাকে আজ রাতে আমি বাইরে থাকবো। একটা ইমিডিয়েট ইনফরমেশন টার্গেট করেছি। চিন্তা করো না, ভিলার ভিতরে একজন পুলিশ অফিসার থাকবে তোমাদের সিকিউর করতে।”
ইশা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,“আপনি একা যাচ্ছেন?”
আরহান পেছনে না তাকিয়েই বলে,“সাথে টিম আছে।”এই কথা বলে সে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।
রাত ৮টা। দরজায় টোকা পড়লো।
ইশা দরজা খুলতেই দেখতে পায়, সাদা শার্ট, ডেনিম প্যান্ট আর কালো জ্যাকেট পরা এক পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। গম্ভীর মুখে নিজেকে পরিচয় দেন,“সাব-ইন্সপেক্টর রিফাতুন নাসরিন। আমাকে আরহান স্যার পাঠিয়েছেন। এই রাতটা আমি এখানে থাকবো, মিস ইশা।”
ইশা একটু অবাক হলেও মাথা নাড়ে,“ভিতরে আসুন।”
নাসরিন ঘরে ঢুকেই পুরো বাড়ি একবার স্ক্যান করে নেয়। তাঁর চোখে প্র্যাকটিস করা শীতলতা আশপাশের নিস্তব্ধতা তার নজর এড়িয়ে যেতে পারে না।
ধীরে ধীরে রাত গভীর হয়, দেয়ালের ঘড়িতে সময় তখন ২টা ৭ মিনিট।চারদিকে শুধু ঘড়ির টিকটিক আর রাতের নীরব নিঃশ্বাস।
হঠাৎ।ঠক ঠক ঠক।
দরজায় একটানা তিনবার কড়া নাড়ার শব্দ।
ইশা চমকে উঠে দাঁড়ায়। বৃদ্ধা তখন ঘুমন্ত, বিছানায় কাঁথা জড়িয়ে আছেন।
ইশা এগিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতে যায়, তখনই পাশ থেকে সাব-ইন্সপেক্টর রিফাতুন নাসরিন দ্রুত এসে বলে ওঠেন,“স্টপ। একটু অপেক্ষা করো।”
নাসরিন হাত ইশার সামনে ধরে দাঁড়ায়।
তার চোখে স্পষ্ট সতর্কতা। দরজার পাশে থাকা ছোট ওয়ারলেস সেটে কিছু একটা বলেন তিনি,
“ আউটার সিকিউরিটি, রিপোর্ট করুন। কে দাঁড়িয়ে আছে মেইন গেটে?”
একটু পর সাড়া আসে “ কনফার্মড। আরহান স্যার।”
নাসরিন ইশার দিকে তাকান, তারপর এক ধাপ এগিয়ে দরজার লক খোলেন। ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে দেন। তারপর স্যার বলে সেলুট দেয়। আরহান উত্তরে কিছু বলে না শুধু মাথা নাড়ে।
ইশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আরহানকে দেখছে। আরহানের দৃষ্টি যেনো তার দিকে স্থির। হঠাৎ ইশার ভীষণ অসস্তি লাগলো। ইশা উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করলো,“ আপনি ফিরবেন না বলেছিলেন।”
আরহান উত্তরে কিছু না বলে ইশার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে।
আরোও পড়ুন:
0 Comments